Wednesday 8 November 2017

স্বপ্নের দেশ অস্ট্রেলিয়া - Dream country to reside; Australia







(আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের এক অধ্যায়ের কিছু স্মৃতি উল্লেখ করার প্রয়াসে আমার এই ব্লগ লেখা, সত্য প্রকাশে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন। )

বিদেশে যাপিত জীবন-
২০০৩ সালে জুলাই মাসের ৩১ তারিখে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে উঠলাম অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে, পৌছলাম পরদিন ১ আগষ্ট  পৌছলাম সিডনীতে। কাষ্টমস ইমিগ্রেশন ঝামেলা শেষ করে প্রবেশ করলাম স্বপ্নের দেশ অষ্টেলিয়া। দেখলাম একবুক খুশি ও গর্ব নিয়ে বড়ভাই দাড়িয়ে আছে আমাকে রিসিভ করার জন্য। আজ জীবনের এই   বাঁকে এসে যখন মন খারাপ হয় তখন আমি বড় ভায়ের সেই মুখখানা কল্পনা করি আর সাথে সাথে খুঁজে পাই স্বজনের প্রতি স্বজনের মমত্ববোধ আর আনন্দের ছোঁয়া। গাড়িতে উঠলাম সরাসরি বাসায় না গিয়ে সিডনী শহর দেখাতে নিয়ে গেলেন। বাসায় ফিরলাম পরিচয় হল মুসা ভাই, সোহেল ভাই, নূরু ভাই, দুলাল ভাই  এর সাথে। পরদিন পরিচয় হল কুমিল্লার ভূইয়া ভায়ের সাথে। আমার তখন একটা নেশা ছিল ইন্টারনেট ব্রাউজ করা।  দেশে থাকতে ২0 টাকা ঘন্টা  করে ইন্দিরা রোডের মাহবুবা প্লাজায় গিয়ে ব্রাউজ করতাম। নিউটাউন সাবার্বে একটা নেট এর দোকান পেলাম এবং মাঝে মাঝে ঐখানে গিয়ে নেট ব্রাউজ করতাম, ভালই লাগত। পরদিন কলেজ খুঁজে বের করলাম। এলিকস কোর্স শুরু করলাম গ্লোবাল কলেজে। অনেক ষ্টুডেন্ট এর মাঝে উন্নত পরিবেশে ভালই কাটছিল দিনগুলো যদিও কিছুদিন পরই চিন্তায় পড়ে গেলাম কাজ কর্ম কিভাবে পাব এটা নিয়ে। সপ্তাহ দুয়েক পরে দেখলাম অনেকেই কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। কয়েকদিন পর শুরু হল নুরু ভায়ের সাথে ভোরে উঠে ক্লিনিং কাজ করা। যদিও এটাতে তেমন কোন কিছু শেখার নেই কিন্তু মাসখানেক হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বেতন বলতে তেমন কিছু পেলাম না।

বন্ধুরা যত

বন্ধুর সংখ্যা হয়ত সঠিক ভাবে বলতে পারব না। সর্বপ্রথম জনির কথা বলতে হয়। আছে ইব্রাহিম এর কথা। সিয়াম, বাবু মাওলানা, সোহেল ভাই, মেহেদী আরও অনেকে আজকে অনেকের কথা মনেও নেই। মনের পড়লে সবার কথাই বলব ইনশাআল্লাহ্ । আরিফুর  জনি পরিচয় রফিক সাহেবের চেম্বারে। আমার কাছে প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল অসম্ভব বুদ্ধিমান। সুন্দর ইংরেজী বলতে পারত দেশে থাকতেই, ওর বাবা নারায়নগঞ্জ সি, আই,ডি তে ছিল। IELTS এর কোচিং করত ও, আমিও মাঝে মাঝে গেষ্ট হিসেবে ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম। সবাই ব্রেক আওয়ারে চা সিগারেট পান করত। আমি প্রায় সময়ই খাওয়াতাম কিন্তু কেউ কখনও আমাকে অফার করত বলে মনে পড়ে না। ও এই ব্যাপারটা খেয়াল করত। একদিন আমাকে বিল দিতে দিল না। আর  বলল এভাবে না খাওয়াতে। ভাল লাগল এবং বন্ধুত্বও হয়ে গেল ওর সাথে যদিও আমার চাইতে প্রায় ৪/৫ বছরের ছোট ছিল কিন্তু চলতাম বন্ধুর মত। সিডনিতে প্রথম দিকে কিংস ক্রস এর ম্যাকডোনাল্ড এর চাকরি হয়ে গেল।


কলিগ
বিশেষ করে গতকাল ২৯-০১-২০২০ তে মনে পড়ল ক্রিস এর কথা, কলোনারী এজ এর কথা বলতে গেলে অবশ্যই যাদের কথা বলতে হয় তাদের মধ্যে ক্রিস অন্যতম। গতকাল আমার ছেলে আফুয়ান বলছিল, “বাবা তুমি কি সব গান জান নাকি নিজে নিজেই বানাও”। ক্রিস ছিল এমন একজন যে সব গান জানত, যে কোন শব্দ বললেই  সেটা দিয়ে গান গাইতে পারত। প্রচুর পরিশ্রম করত  এবং সর্বদাই ডেকসেট এ গান শুনত। ২০০৩-০৪ সালেও টেপ ক্যাসেট পাওয়া যেত অষ্ট্রেলিয়াতে। সারাক্ষণই  আমুদে স্বভাবের ক্রিসকে একদিন দেখলাম মন খুব খারাপ। নিমিষেই কলোনারী এক এর সবাই কাজ থামিয়ে দিল এবং জানতে পারলাম ওর ব্রেক আপ হয়েছে। বিশেষ করে ও তার বান্ধবীকে খুবই ভালবাসত, প্রায়ই কাজের ফাকে বান্ধবীর ছবি দেখাত। মেয়েটার সাথে থাকাকালীন সমস্ত খরচ ওই বহন করত। কিন্তু মেয়েটা বিট্রে করল শেষ পর্যন্ত। কে বলে যে বিদেশীদের ভালবাসা নেই? আসলে ভালবাসাটাকে আমরা আমাদের নিজেদের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে ভালবাসি। সবাই কাজ থামিয়ে একে একে সমবেদনা জানালাম। আমিও এমন সমবেদনা পেলাম যেদিন জানতে পারলাম আমার সেঝুভাই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেল, সেদিনও সবাই আমাকে সমবেদনা জানিয়েছিল। এই একটা ব্যাপার ওদের মধ্যে আছে, কেউ কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলে বা কারও কোন ক্ষতি হলে সবাই সমবেদনা জানায়। আমরা এটুকুও করতে জানি না।  
মাসালা হাউজ
আমার অস্ট্রেলিয়ার গল্প পূর্ণই হবে না যদি না আমি মাসালা হাউজের কথা বর্ণনা করি। শুরুতেই কিছুটা ভূমিকার প্রয়োজন বোধ করছি। পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বাংলার মাটি ছেড়ে রওয়ানা হলাম অস্ট্রেলিয়াতে এবং এখানে কাটালাম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি বছর। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের জন্য বিভিন্ন জায়জায় গিয়েছে ও কাজ করেছি। তন্মেদ্ধে মাসালা হাউজ, কলোনারী এজ, চার্লিস কিচেন, এম সি এ, ওপেরা হাউজ রেস্টোরেন্ট, স্পিট জংশন এর রেস্টোরেন্ট অন্যতম। প্রথমেই মাসালা হাউজের প্রতিষ্ঠাতা জনাব আলমগীর মোড়ল, বাংলাদেশে বাড়ি ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার  উত্তর শিমুলিয়া গ্রাম। যাই হোক যতদূর জানা যায় সর্বপ্রথম মাসালা হাউজ প্রতিষ্ঠিত হয় এনমোর (Enmore- Close to Enmore Theatre, Sydney, Australia) এ ২০০০ খ্রীষ্টাবের কিছু আগে বা পরে।  বেশ কিছুদিন ব্যবসা করার পর তিনি তারই এক ঘনিষ্ঠজন কুমিল্লার ভূইয়া সাহেবের কাছে বিক্রি করে দেন এবং পরবর্তীতে অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত বনডাই বিচ সংলগ্ন হল স্ট্রিট ও ওব্রায়ান স্ট্রিট এ কর্ণারে নতুন করে শুরু করেন মাসালা হাউজ ফাইন ডাইনিং রেস্টোরেন্ট। সময়টা ছিল ২০০৩ সাল যখন আমি নূরু ভায়ের সাথে প্রতিদিন সকাল ৪:৩০ মিনিটে উঠে ক্লিনিং কাজে যেতাম। সেই ভোর থেকে বেলা ৮টা বা ৯টা পর্যন্ত সপ্তাহে কাজ করতাম এবং এক মাস পরে বেতন হিসাবে পেলাম মাত্র ৮০ ডলার যা বাংলা টাকায় ছিল প্রায় ৩,৫০০ টাকার মত, এটা অমানবিক। যেকানে গড় পড়তা ক্যাশ ইন হ্যান্ড কাজেই ঘন্টায় পাওয়া যেত ৭/৮ ডলার সেখানে আমি পেলাম .৮ ডলার। ঠিক তখনই আলমগীর ভায়ের রেস্টোরেন্ট এর লোক দরকার হল আমিও চাইছিলাম কাক ডাকা ভোরে উঠার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে।

হেড শেফ আলমগীর ভাই, তান্দুরী শেফ সোহেল ভাই যিনি আলমগীর ভায়ের শ্যালক আর আমি  কিচেনহ্যান্ড কাম মিডলম্যান। বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১/১২ টা পর্যন্ত কাজ এবং কাজ শেষে আলমগীর ভায়ের গাড়ীতে করে বাসায় ফেরা। তবে বেশির ভাগ সময় বড় ভাই কাজ শেষ হওয়ার আগেই চলে আসতেন। মনে পড়ে ওল্ড সাউথ হেড হয়ে বন্ডাই জংশন হয়ে মোর পার্ক হয়ে রেডফার্ন, নিউটাউন, ম্যারিকভিল হয়ে ডালউয়িচ হিলে বাসায় ফেরা। কত শত হাসি কষ্টের কথা বলতে বলতে বাসায় ফেরা আর সেটাও একটা ইতিহাস হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন ওয়েটার এর সাথে এক আপু এবং মার্ক নামের জার্মানীর একটা ছেলে। তুলনামুলক ভাবে এখানে বেতন ভাল ছিল প্রতিদিন ৫০ ডলার আমার জীবনের প্রথম ইনকাম এটাকেই বলা চলে। তখন বেতন পেলে বা কিছু কিনতে গেলে আগে হিসাব করতাম বাংলা টাকায় কত হয়। যাই হোক কাজ করছি, বাসনকোসন ধুচিছ, মিডলম্যান এর কাজ করছি কিন্তু হঠাৎ করেই মার্ক জার্মানীতে চলে গেল। ফ্রন্টে এবার কাজের লোক লাগবে।  আমাকে বলা হল সামনে কাজ করতে, আমি তো মহাখুশি কিচেনে গরমে কাজ করার চাইতে সামনে সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরে বিদেশী কাষ্টমার দের খিদমত করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে বারবার বাহবা দিচ্ছিলাম, কিন্তু  হায় কাজ করতে গিয়ে অনুভব করলাম সামনে ওয়েটারের কাজ করা কতটা যে কষ্টকর। এমন একটা সময় হল যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলতাম। এক টেবিলের অর্ডার আরেক টেবিলে দিয়ে আসতাম, কিযে মানসিক চাপ। তখন বুঝতে পারলাম সামনে সুটেড বুটেড হয়ে থাকার চাইতে পেছনে পিয়াজ কাটাও অনেক শান্তির।


কলোনারী এজ
যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে কোথায় কাজ করতে পারলে ভাল লাগবে?? আমি অকপটে বলব ‘কলোনারী এজ’। এটা সিডনী শহরের ম্যারিকভিলা সাবার্বের অন্তর্গত লিলিয়ান ফাউলার স্ট্রিট এ অবস্থিত ছিল কিন্তু বর্তমানে এটা ক্যারিংটন স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়েছে। এক্সিকিউটিভ শেফ সাইমন ফক্স (একটু মাথা কেমন যেন, ) নামকরা ব্রিটিশ শেফ। অসম্ভব সুন্দর পার্টি অর্গানাইজ করতে পারত। বিশেষ করে ফুড সেকশন টা উনার ছিল নখদর্পনে। একটা মজার বিষয় হল ব্রিটিশটা কোন শব্দ পুরোটা উচ্চারণ করে না, অর্ধেকটা পেটের ভিতর রেখে দেয়। উনিসহ সবাই আমাকে ডাকত গাইজা, যদিও আমি সবাইকে বার বার পই পই করে বলতাম আমার নাম ’গাইজা’ নয় ‘কায়সার’। যাই হোক এখানেই আমার সাথে পরিচয় হয় তাহমিনা ভাবী, নিশা ভাবী, গ্যারি (চাইনিজ), ব্রাড, বেলিন লি (কানাডিয়ান), ডিডিয়ে ও ইয়ানিক (দুজনেই ফ্রেঞ্চ), ডগলাস (রাগবি খেলোয়ার, গিটারবাদক এবং গায়ক), ক্যারোলিন, কাভোয়া সহ আরো অনেকে। কোম্পানীর মালিক ছিলেন চার্লস ও রিচার্ড, দুইজনেই ফ্যাগ এড  বা গে। উনাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু উল্লেখ করার নেই। কিন্তু যার কথা না লিখলে লেখার সার্থকতাই থাকবে না, সে হল হেড শেফ ক্রেইগ যোসেফ। অসাধারণ একজন ব্যাক্তি বয়স তখন ৩৭/৩৮ হবে, আদি নিবাস সাউথ আফ্রিকা, পূর্বপুরুষ ব্রিটিশ কিন্তু সাউথ আফ্রিকান একসেন্টে কথা বলতেন। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। আমরা কেউ কোনদিন উনার আগে কাজে উপস্থিত হতে পেরেছি মনে পড়ে না। উনি ছিলেন পুরো ক্যাটারিং এর হেড শেফ আর আমার বড় ভাই মোক্তার হোসেন ছিলেন কিচেন হ্যান্ড সেকশনের হেড স্টাফ। ক্রেইগের মত ধৈর্য্যশীল ব্যক্তি আমার জীবনে আর একটাও দেখব কিনা জানিনা। উনার একটা কথা আমি আমার জীবনে সবসময় মেনে চলতে চেষ্টা করব আর সেটা হল, “আগে বুঝি নিবে তুমি তোমার কাজটা জান কিনা? যদি না জান বা না বুঝ অবশ্যই বলবে যে আমি জানিনা, কিন্তু কখনেই না জেনে কখনই কোন কাজ করবে না।” উনাকে কখনই ধৈর্য্যহারা হতে দেখিনি।


এম সি এ ক্যাফে
 এম সি এ ক্যাফে আসলে কলোনারী এজ এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এটা একটা রেস্টোরেন্ট যা মিউজিয়াম অফ কন্টোমটরী আর্টস বিল্ডিংএ অবস্থিত এবং অপেরা হাউজের উল্টোদিকে এবং সার্কুলার কি স্টেশনের পাশে। একটা সময় এখানকার হেড শেফ হয়ে আসে বন্ধভাজন ইংল্যান্ডের এক শেফ। আমার সাথে ভাল সখ্যতা থাকলেও আনোয়ার ভাই এর সাথে প্রায়ই লেগে থাকত। আমি আমার ব্যক্তিগত লাইফে দেখেছি যে, বাঙালীরা একটুখানি পজিশনে গেলেই ভাবে না জানি কি হয়ে গেছে। কারও সাথে ব্যক্তিগত বিরোধ থাকলে সেটা কাজের সময় প্রয়োগ করাটা বাঙালী একটা চিরাচরিত স্বভাব। আমি যেটা করতাম কাজের সময় ব্যক্তিগত সম্পর্কের ধার ধারতাম না। তাই, দেখেছি আমি যখন যেখানে কাজ করেছি সবাই আমাকে অনেক আদর করেছে। কাজটা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করলে অনেক সময় শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হয়। এ জে ছিল আমাদের ওখানকার পার্টির ক্যাপ্টেন। অনেক কড়া মহিলা। সার্ভিস ১০০% না হলে কোন ছাড় ছিল না। এখানে প্রায় সময়ই পার্টি লেগে থাকত, যদিও আমি মেইন কিচেন কলোনারী এজ এ কাজ করতাম কিন্তু প্রায়ই আমাকে প্রিকুক করা খাবার নিয়ে মাইক্রো ভ্যান নিয়ে পৌছে দিতে হত এবং ওখানকার পার্টি শেষ করে অনেক রাত্রে লেফট্ওভার নিয়ে মেইন কিচেনে পৌছে দিয়ে বাসায় ফিরতে হত। প্রায় সময়ই রাত ১টা ২টা বেজে যেত। এখন বুঝি তারা আমাকে পছন্দ করত এজন্য যে আমি মন প্রান দিয়ে আমার কাজটা সম্পন্ন করতাম।



এস টি সি ক্যাফে
 এস টি সি কলোনারী এজ এর আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল বর্তমানে সিডনী থিয়েটার কোম্পানীর সাথে চুক্তি শেষ হওয়ায় ক্যাফেটি ছেড়ে দিয়েছে। এবং বন্ডাইতে ”দি ক্লাবহাউজ’ নামের আরেকটি রেস্টোরেন্ট নিয়েছে। 


চার্লিস কিচেন 
অল্পকিছুদিন আমি চার্লিস কিচেনে কাজ করেছি। এটা ছিল একটা অনন্য অভিজ্ঞতা। এখানে পেমেন্ট ভাল ছিল এবং হাতে হাতে বেতন দিত যদিও বেশিদিন এখানে কাজ করা হয়নি। যদিও অল্প কিছুদিন এখানে কাজ করেছি কিন্তু উল্লেখ করছি এজন্য যে, এটাই আমার প্রথম কাজ যেখানে আমি আমার নিজের যোগ্যতা প্রমান করার সুযোগ পেয়েছিলাম। চার্লি হল ইন্ডিয়ার পাঞ্জাব প্রদেশের লোক এবং অস্ট্রেলিয়াতে মাইগ্রেট করার আগে মালেশিয়াতে ছিল। উনার সাথে কাজ করত আরেকটা মালেশিয়ান ছেলে, একই সাথে মাইগ্রেট করেছিল। এটা ছিল মূলত একটা ব্রিসটো, যারা জানেন না তাদের বলছি ব্রিসটো হলো পাব বা বারের পাশে একটা খাবার ব্যবস্থাপনার জায়গা যেখানে সাধারণত হালকা খাবার পাওয়া যায় এবং অনেক জায়গায় ভারী খাবারও পরিবেশন করা হয়। ২০০৬ এর দিকে সরকার কর্তৃক নিয়ম করে দেয়া হয় যে প্রত্যেক পাব/বারে অবশ্যই ব্রিসটো থাকতে হবে অথবা হালকা খাবার রাখতেই হবে। যাই হোক মূল বিষয়ে চলে যাই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করলাম এবং মালিক বললেন অমুক দিন আসুন। প্রথম দিন, তখন আমি কলোনারী এজ এ পার্ট টাইম ক্যাজুয়াল স্টাফ, গেলাম চার্লিস কিচেনে। মালিকের সহকারী কুক বললেন যে মালিক নেই পরে আসবে। আমার কথা নাকি বলে গেছেন আমি আসলে যেন কিছু কাজ করে দেই। আমাকে দিলেন প্রায় এক কেজি মাশরুম স্লাইস করতে এবং বলে গেলেন আধা ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই যেন শেষ করি।  ইতিপূর্বে আমি ক্যাটারিং এ অনেক মাশরুম কেটেছি এবং পরিমাণে অনেক সময় ২০ কেজিও বেশি থাকত, তাই আমার কাছে কেজিখানেক মাশরুম কাটা কোন ব্যাপারই ছিল না। আমি ১০ মিনিটের মধ্যে সব কেটে শেষ করে ফেললাম। সহকারী ফিরে এল প্রায় ১৫ মিনিট পর এবং আমার কাজ দেখে ওনার তো চক্ষু চড়কগাছ, বলল আমি মেশিন কিনা? আমি অভয় দিয়ে বললাম আমি মোটেই মেশিন নই তবে চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। মালিক আসলে কিছুক্ষন পরে, আসলে এসবই ছিল আমার পরিক্ষা। মালিক তার সহকারীকে বললেন, ”দেখ কিভাবে কাজ করতে হয়। ” বেতন ঠিক হল ঘন্টায় ১৫ ডলার তাও আবার হাতে হাতে। সত্যিই অভাবনীয়। আমার জীবনে খাওয়া ল্যাম্ব কারি যত খেয়েছি ওনারটা ছিল সবচাইতে ভাল, সুস্বাদু ও মুখরোচক। আমার তখন আবার ইগো প্রব্লেম ছিল অনেক বেশি তাই সামান্য একটা ব্যাপারে ভুল -বুঝাবুঝির জন্য সরাসরি মুখের উপর বলে দিলাম কাজ করব না। আসলে তখন আমার কাজের অভাব ছিল না বিধায় এমনটা করেছিলাম। কিন্তু এ কাজটা ধরে রাখলে হয়ত আজ আমার এমন অবস্থা হত না।



অপেরা হাউজ রেস্টোরেন্ট
তখন আমি কাজ করতাম কলোনারী এজ এর MCA ক্যাফেতে। তখন কাজের চাপ কম থাকায় কাজের জন্য গেলাম অপেরা হাউজ রেস্টোরেন্ট এ। এখানে তখন কাজ করত ইউসুফপুরের আনোয়ার ভাই। উল্লেখ্য যে ইতিপূর্বে এখান থেকে আমাকে ডেকেছিল কিন্তু তখন আমি না গিয়ে অন্য এক যুবককে পাঠালাম। মনির নাম, উনার ওয়াইফ এর সাথে পরিচয় ছিল এবং তখন মনিরে কোন কাজ ছিলনা বিধায় ভাবলাম আমার তো কাজের অভাব নেই কিন্তু কাজটা আমার চাইতে মনিরের বেশি দরকার। বিধি বাম, একদিন কাজ করে মনির আর কাজে যায়নি। তার কাছে মনে হয়েছে ওখানে কাজ করলে তিনি নাকি মরে যাবেন যা পরবর্তীতে ভূল প্রমানিত করে আমি বহুদিন কাজ করেছি। ওখানে প্রধান কাজ ছিল লোডিং ডক থেকে পণ্য বুঝে নিয়ে তা কুল রুম বা ফ্রিজারে তুলে রাখা। দেখেছি ওখানে নিরাপত্তার বলয়টা বেশ শক্ত ।

ক্যারিয়ার এ্যাজ এ ট্যাক্সি ড্রাইভার
২০০৬ এর শেষের দিকের কথা, অনেক কাঙ্খিত ট্যাক্সি লাইসেন্স পেলাম। তার জন্য আমাদে সিডনী ট্যাক্সি স্কুলে ভর্তি হতে হল আরও ৯ মাস আগে। সাধারণত ৬ মাস সময়ের মধ্যেই মানুষ লাইসেন্স পেয়ে যায় নানান কারনে আমার লাগল প্রায় ৯ মাস। উল্লেখ্য যে, ট্যাক্সি লাইসেন্স পাওয়ার প্রধান শর্ত আপনার ড্রাইভার লাইসেন্স থাকতে হবে, মাইগ্রেশন ইংলিশ পরিক্ষায় পাশ করতে হবে এবং কোন স্বীকৃত ট্যাক্সি স্কুলে পড়তে হবে। উক্ত ট্যাক্সি স্কুল ইন্টারনাল পরিক্ষা নিবে এবং তারা যখন ওকে বলবে শুধুমাত্র তখনই আপনি ট্যাক্সি লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করতে পারবেন, অন্যথায় সম্ভব নয়। আমাদের দেশের মত ঘুস বা দুর্নীতির কোন বালাই নেই। অনেক স্মৃতি আছে আমার  এই পেশায়, ভাল মানুষ যেমন পেয়েছি তেমনি দুষ্টু লোকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। গাড়ি চালাতে গিয়ে অনেক যাত্রীর হারানো মালামাল পেয়েছি এবং ট্যাক্সি বেস এ জমা দিয়ে প্রসংশাও কুড়িয়েছি অনেক। একবারের একটা ঘটনার কথা বলি। যাত্রী নিয়ে মেইন সিটি থেকে Wooloomooloo তে গিয়েছি, ড্রপ অফ করলাম এবং ফিরে আসছিলাম। Darlinghurst পার হয়ে Redfern এর ক্রাউন স্ট্রীতে গাড়ি নিয়ে বেস এর ফিরছিলাম। এটা ছিল আমার ঐদিনের মতো শেষ ট্রিপ।  হঠাৎ করে পিছনে তাকিয়ে মনে হল কিছু একটা যাত্রী মনে হয় ফেলে গেছে। গাড়ি থামালাম, দেখলাম একটা আই ফোন। ২০০৭/০৮ এর দিকে এমন একটা ফোন খুব দামী ছিল এবং এটা কেনার মত সাহস করতে পারি নাই, যদিও ইচ্ছা ছিল একটা কিনব কিছু টাকা জমিয়ে। নিজের সাথে দ্বন্ধে পড়ে গেলাম ফিরত দিব কি দিব না। সত্যি কথা বলতে কি লোভ হচ্ছিল খুব। ফোন টার সুইচ অফ করে দিলাম এবং আবার গাড়ি চালাতে লাগলাম। আমার কি হল জানিনা, এত গরম আর অস্থির লাগছিল বলার মত না। এসি ফুলস্পীডে দিয়েও ঘাম বন্ধ করতে পারছিলাম না। নিজের ভেতর অজানা একটা ভয় অনুভব করছিলাম সাথে সাথে অনুশোচনা। ৫০০ মিটারের মত যেতে পেরেছিলাম, তারপর গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে বের হয়ে ফোনটা চালু করলাম। শেষ ডায়াল নাম্বারে ফোন করে জানালাম যে ফোনের মালিক ফোন টা হারিয়ে ফেলেছে আমার ট্যাক্সিতে। আমাকে ওপাশ থেকে বললেন আমি যদি ফোনটা পৌছে দিই তাহলে আমাকে ভাড়া দিয়ে দিবে। যেতাম কিন্তু আমার শিফট শেষ, এবং গাড়ি জমা দিতে হবে জানিয়ে অপারেটরের কাছে জমা দিব জানালাম। ওখান থেকে যেন পরে নিয়ে নেয়। অনেক ধন্যবাদ পেলাম ওনার কাছ থেকে। পরে চিন্তা করে দেখেছি যে, আমার দ্বারা কারো কিছু মেরে দেয়া সম্ভব নয়।


আইসক্রীম